মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ:
১৭ থেকে ২২ বছর বয়স হলো একটি কিশোর-কিশোরীকে পূর্ণবয়স্কের পথে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বয়সে তারা স্বপ্ন দেখতে শেখে, দায়িত্ব নিতে শুরু করে, এবং স্বাধীনতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একজন তরুণের ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের জন্য এই সময়ে পিতামাতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহ এবং আধুনিক বিজ্ঞান থেকে অভিভাবকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরা হলো, যা তরুণদের বিকাশে সাহায্য করতে পারে।
আধ্যাত্মিকতা ও ঈমানের বিকাশ কুরআনে বলা হয়েছে, “পড়, তোমার প্রভুর নামে” (সূরা আলাক, ৯৬:১)। এই নির্দেশনার মধ্যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। আধ্যাত্মিকতা একটি তরুণকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে সাহায্য করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি আস্থা তৈরি করে। বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে যে, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চর্চা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং তাকে ধৈর্যশীল ও ইতিবাচক করে তোলে। তরুণদের নিয়মিত সালাত আদায়, কুরআন অধ্যয়ন এবং আল্লাহর স্মরণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। এই অভ্যাসগুলো তাদের ঈমান ও আত্মবিশ্বাসকে শক্তিশালী করবে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি গড়ে তোলা নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, অন্যদের জন্যও তা চায়।” এই সহানুভূতির শিক্ষাটি তরুণদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সামাজিক সম্পর্ক গড়তে সহায়তা করে এবং এটি একটি সফল ব্যক্তিত্বের একটি অন্যতম দিক। তরুণদের কমিউনিটি সার্ভিস বা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা উচিত, যা তাদের মধ্যে সহানুভূতির গুণাবলী এবং দায়িত্ববোধ তৈরি করতে সাহায্য করবে।
স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গড়ে তোলা ইসলামে মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ও দায়িত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা যখন সিদ্ধান্ত নিতে শেখে, তখন তাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। পিতামাতার উচিত তাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করা। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, স্বাধীনতা এবং পিতামাতার সহানুভূতিপূর্ণ গাইডেন্স তরুণদের আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ বাড়ায়। ভুল থেকে শেখার জন্য সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
আজীবন শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করানো কুরআনে বলা হয়েছে, “যারা জ্ঞান রাখে আর যারা জ্ঞান রাখে না তারা কি সমান হতে পারে?” (সূরা আল-যুমার, ৩৯:৯)। এই আয়াত আমাদের শিক্ষা এবং জ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করায়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য আবশ্যক” (ইবনে মাজাহ ২২৪)। এই শিক্ষা জীবনের একটি আজীবন চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিত্ব গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, নতুন কিছু শেখা এবং জ্ঞানের চর্চা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক। প্রতিদিন নতুন বিষয় সম্পর্কে শেখা এবং গবেষণার মাধ্যমে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে পারে, যা তার চিন্তা-ভাবনা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকে উন্নত করে। পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদের নতুন বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা এবং উচ্চশিক্ষা কিংবা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও মনোভাবকে পরিশীলিত করার সুযোগ প্রদান করা।
ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার গুণাবলী তৈরি করা ধৈর্য এবং কৃতজ্ঞতা আমাদের জীবনে মানসিক স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। নবী (সা.) সব সময় ধৈর্যশীলতা ও কৃতজ্ঞতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তা আমাদেরও অনুসরণ করা উচিত। ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ধৈর্য এবং কৃতজ্ঞতার অভ্যাস একটি মানুষকে জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তরুণদের জীবনেও ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ হতে শেখানো প্রয়োজন।
শারীরিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা রক্ষা করা ইসলামে শারীরিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। নবী (সা.) বলেছেন, “তোমার শরীরেরও তোমার উপর অধিকার আছে।” এই নির্দেশনা তরুণদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানও বলছে যে, সুস্থ শরীর মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। তরুণদের সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস তৈরি করতে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ এই অভ্যাসগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনে শক্তি ও স্বচ্ছতা এনে দেয়।
সামাজিক দায়িত্ব এবং কমিউনিটি সংযোগ গড়ে তোলা নবী (সা.) বলেছেন, “মানুষের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে অন্যদের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত করে।” কমিউনিটি সম্পৃক্ততা কিশোর-কিশোরীদেরকে সহানুভূতিশীল এবং দায়িত্বশীল করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে উৎসাহিত করা, যাতে তারা নিজেদের সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখে।
ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা আজকের যুগে ডিজিটাল মাধ্যম জীবনের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। তবে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের কারণে অনেক তরুণ মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। ইসলাম আমাদের সংযম শিখিয়েছে, যা এই ডিজিটাল যুগে আরও গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদেরকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সংযমী হতে এবং সঠিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাখতে উৎসাহিত করা জরুরি।
বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করা ইসলামে সকল মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একটি মৌলিক নির্দেশনা। বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি একজন মানুষকে সহানুভূতিশীল এবং মানবিক করে তোলে। তরুণদেরকে বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বৈচিত্র্যের জন্য ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার জন্য পিতামাতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুণাবলী তাদেরকে বৈশ্বিক মানসিকতার দিকে নিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সফল হতে সহায়তা করে।
পরিশেষে ১৭ থেকে ২২ বছরের এই বয়সটি একটি কিশোর-কিশোরীর জন্য জীবনকে উপলব্ধি করার এবং স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তোলার একটি বিশেষ সময়। কুরআন, সুন্নাহ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাওয়া এই পদ্ধতিগুলো তাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ, আস্থা এবং দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। পিতামাতার জন্য এটি এক কঠিন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই সময়ে তাদের পরামর্শ এবং সমর্থন তরুণদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করবে এবং তাদের একটি সফল ও অর্থবহ জীবন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।